[দশম পর্ব]
ছবিঃ আলেখ্য বাগচী
যা কিছু ঘটেছে সেই
সমস্ত কিছুর পরে, আমার কবিতাগুলো কি ফেলে দেওয়ার মতো? (আইডেন্টিটি কার্ড, নজওয়ান দরবিশ)
ভারতবর্ষ ও রবীন্দ্রনাথ
মেলার অনেক ভিড়, সেই
ভিড়ে কিছু যেন খুঁজছি আমি। কিচ্ছু কিনব না সে মেলা থেকে। কিছু কেনার পয়সাও নেই হয়ত
পকেটে। কিন্তু অনেক অনেক মানুষের সেই ভিড়ে গিজগিজ করা মেলায়, আমি যেন একটা মুখ,
একটা মানুষের মুখ খুঁজছি। যে-মুখ আমি আগে কখনও সামনে থেকে দেখিনি। যার গলা কখনও শুনিনি।
যে আগে কখনও আমায় ছোঁয় নি। আমি কিন্তু জানিই না সে কে। তাকে
আদৌ পাব
কিনা এখানে তাও জানি না। তাকেই এখানে পাব ব’লে এসেছি তা-ও নয়। এভাবেই ঘুরতে ঘুরতে,
তাকে যেন কিভাবে পেয়ে যাব, একটা ভীষণ ভিড়গ্রস্ত মেলায়।
অনেক খুঁজেও রবীন্দ্রনাথকে কোথাও পাওয়া যায় না। তাঁর
গান আছে। ছবি আছে। গল্প কবিতা নাটক প্রবন্ধ চিঠি উপন্যাস কেচ্ছা সব আছে। লোকটার
দেখা নেই। লেনন থেকে লোরকা, মোপাঁসা থেকে মীরা বাঈ, চৈতন্য থেকে চেকভ সবাইকে পাওয়া
গেছে। রবীন্দ্রনাথ নেই শুধু। স্বর্গ মর্ত্যের দালানে দালানে আড্ডা দেন কমলকুমার আর
রামপ্রসাদ। বঙ্কিম আর মার্কেজ। মেঘের ওপর মেঘ জমে একটা গম্বুজ মতো তৈরি হয়। সেই
গম্বুজ কেটে ওপরটাকে সমতল করা হয়েছে। রোজ সকালে সেখানে একটা মৃত নক্ষত্রের পিণ্ড
নিয়ে একা ড্রিবলিং করেন আলব্যের কাম্যু। অমিয়ভূষণ রামকিঙ্কর শক্তি বিনয় ভ্যান গঘ, আকাশের মোড়ে মোড়ে মেঘ
সরালেই দেখা হয়ে যায় কত কতজনের সাথে। দু’টো মেঘের মাঝখানে যে সরু গলি তৈরি হয়
এঁকেবেঁকে, তার রাস্তা ধ’রে বিকেলে হেঁটে যান ঢোলা
পাজামা পরা ঋত্বিক আর রণেন রায়চৌধুরী। মেঘ
ভেঙে যাওয়া রোদ্দুর এসে তেরছা ভাবে পড়ে ওঁদের গায়ে। অনেক দূর থেকেও শোনা যায় দয়ানি
রাখিবায় মোরে। কৃষ্ণগোপাল মল্লিক যেমনটি লিখেছিলেন হুবহু সেই
ভঙ্গিতে মেঘের স্পঞ্জে পা ফেলে হেঁটে যাচ্ছে কে ও? মদে চুর হয়ে বেহুঁশ ‘পাঁড় মাতাল
লম্পট একবগলে লক্ষ্মী একবগলে সরস্বতী আর কোঁচড়ে রামকৃষ্ণকে পুরে ড্যাং ড্যাং চলে
গেল ভুঁড়ির ওপরে বুকের কাছে কষি বেঁধে খেটো ধুতি প’রে আর খালি গা’। কে ও?
গিরিশচন্দ্র ঘোষ। একটু ওই ব্রিজ
পেরিয়ে নেমেই ডানদিকে চলে যাওয়া কালো রাস্তাটা ধরে অনতিদূর গেলে দেখা যাবে লালে
লাল কৃষ্ণচূড়াটার নিচে দাঁড়িয়ে সার্ত্র আর সীমোন তুমুল ঝগড়া করছে। ব্রিজ থেকে
রাস্তাটা ধরলেই শোনা যাবে ওদের গলা। হিচককের
স্পেলবাউন্ড ছবিতে দালি
নির্মিত স্বপ্নদৃশ্যে টেবিলের ওপর যেমন অনেকগুলো ছায়া পড়েছিল লম্বা লম্বা,
রাস্তাটায় গাছের ছায়াগুলোও ওইভাবে, ঠিক ওইভাবে রোদ আর ছায়া নিয়ে ডোরাকাটা করেছে।
ওদের দুজনের হাতেই এক-বান্ডিল লা কোজ দ্যু প্যপ্ল্, মাওবাদী পত্রিকা, বিলি করতে
বেরিয়েছে। কাছেই মঁপারনেস-এর কবরখানা। বোদল্যের, বেকেট সবাইকেই পাওয়া যাবে সেখানে।
এদিকে কাফকার কাছে প্রায়ই যান
সন্দীপন। গালাগাল শুনতেই যান বোধ’য়। ‘কী সব সেলফ্-প্লাজিয়ারিজমের লেখা। এ’ তো
আত্ম-টুকলি। আমার তো এটা ভাবলেই আবার ম’রে যেতে ইচ্ছে হয় যে আমার ডায়রিটা আমি নিজে
হাতে কেন পুড়িয়ে এলাম না। কী গাণ্ডু ছিলাম আমি। পোড়াবার দায়িত্ব নিজেকেই নিতে হয়।
কাউকে বিশ্বাস করতে নেই শালা।’ ডানলপের ওপর দিয়ে চলে যাওয়া ফ্লাইওভারটায় সারাদিন
পা ঝুলিয়ে ব’সে থাকেন ভাস্কর। মন ভালো নেই মন ভালো নেই মন। তাও এখনও জেদ ধ’রে ব’সে
আছেন কিছুতেই ডিপ্রেসড হবেন না। রাতের বরানগরে বি টি রোড টবিন রোড ধ’রে হাঁটতে
হাঁটতে গলা ছেড়ে গান,
কী পাইনি তার হিসাব মেলাতে মন মোর নহে রাজি। গভীর রাতে পার্কের গাছে গাছেরই ডাল
ছুঁড়ে মারেন জীবনানন্দ। জিগ্যেস করলে বলেন, ‘মানুষ কি মানুষকে ঢিল ছুঁড়ে ডাকবে
না-কি? গাছকে ঢিল ছুঁড়ে ডাকা কোন্ দেশের সভ্যতা?’
জীবনানন্দ যখন
লেখেন, ‘হাজার বছর আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে’, কেন তিনি লিখলেন না, হাজার বছর
আমি ঘুমাইতেছি পৃথিবীর কোলে কিংবা হাজার বছর আমি ছুটিতেছি পৃথিবীর মাঠে। ‘হাঁটা’
এবং ‘পৃথিবীর পথ’কেই কেন তিনি বেছে নিলেন। ঠিক কোন্ তাড়নায় এবং দর্শনে একজন কবি
এতগুলি সম্ভাবনা ও বিকল্পর থেকে একটিকেই বেছে নেন? এবং কেন? এবং কিভাবে কবিতায়
একটি সম্ভাবনা অথবা বিকল্পকে বেছে নেওয়ার পরেও সচল থাকে অন্য সম্ভাবনাগুলি? এবং
সেই অন্য সম্ভাবনাগুলির থ্রেড ধ’রে পাঠক কিভাবে পৌঁছন আরেকটি সমান্তরাল কবিতায়?
তাহলে কি একটি কবিতায় কবি যা যা ঘটাতে পারত, তার সবগুলোই পাঠক ঘটিয়ে চলেন বা
ঘটাবার সম্ভাবনা রাখেন অসংখ্য অন্য অন্য কবিতায়?
এ’ এক আশ্চর্য কমিউন। আন্তর্জাতিক। দেশ কাল ভাষা
সীমানা, ফুঃ, এই সময়ের ভেতর আরেকটা সময়ের খোল তৈরি হয়েছে, সেখানে বসেছে মৌতাত।
কীভাবে যেন একদিন, এমন-কি অবন ঠাকুরকেও পাকড়াও করা গেছিল। এখনও যেখানে যান পাথর
কুড়িয়ে রাখেন পকেটে। কিন্তু পরলোকে গিয়ে কেউ কক্ষনো রবীন্দ্রনাথের দেখা পাননি। রবীন্দ্রনাথ যে
কোথায় গেলেন। শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ অভিমান নিয়ে হারিয়েই গেল লোকটা। কখনও
গুজব শোনা যায়, নৈঋতে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে
থাকা মেঘে না-কি ওঁর ছায়া দেখা গেছে। ওটুকুই। বেলাশেষের হাওয়ায় দীর্ঘ জোব্বা প’রে,
পেছনে দু’হাত, সামনে অল্প ঝুঁকে কেউ যেন হেঁটে যায় অলোকানন্দা নদী তীর ধ’রে। এক
আকাশ তারা বুকে নিয়ে বঙ্কিম কতদিন ভেবেছেন ওঁর কথা। কখনও কি ভোলা যাবে সেই দ্বৈরথ।
স্বদেশ আজ বড় চঞ্চল হে।
এরইমধ্যে একদিন, বিকেল, বঙ্কিমচন্দ্র আর গৌরকিশোর
ঘোষ, বঙ্কিমের বাড়ির ছাদে। অমল আর শ্যামার উত্তীয় নিয়ে আসে একটা চিঠি। কেউ যাঁর
দেখা পায়নি, তাবড় দুনিয়া যাঁর ছায়া নিয়ে গুজব ছড়ায়, সেই লোকটারই চিঠি। তাঁর নিজের
কোন্ অচিন স্বদেশে ব’সে লেখা। ইংরিজিতে লিখেছেন। কমার্শিয়াল সিভিলাইজেশন,
জাতীয়তাবাদ আর মানুষ নিয়ে সে কী এক চিঠি। বারবার পড়েন বঙ্কিম। গৌরকিশোর। দিকে দিকে
সেদিন খবর রটে যায়; বঙ্কিমের কাছে রবীন্দ্রনাথের চিঠি এসেছে। আইনস্টাইন, রমাঁ
রোল্যাঁ, বার্ট্রাণ্ড রাসেল নিজে এসে প’ড়ে যান সেই চিঠি। মানুষের
থেকে দেশ দল নীতি মতবাদ কিছুই যে বড় নয়, অনেকদিন পর বুক বাজিয়ে আবার সেই কথাটা বলল
কেউ। জাতীয়তাবাদের তত্ত্ব নিয়ে বঙ্কিমের সাথে রবীন্দ্রনাথের তর্ক, রবীন্দ্র-গান্ধী
তর্ক, ইতিহাস জানে। একা
দাঁড়িয়ে এই লোকটাই বলেছিল, আমাদের দেশের জন্য বাইরের থেকে তত্ত্ব আনতে হবে কেন!
পরে লিখেওছিলেন এ’ নিয়ে, বিস্তর। একবার তো বলেই বসলেন,
জাতীয়তাবাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হ’ল সে তোমায় শেখায় মানুষের থেকে দেশ বড়। এ’ তো
আসলে সেলফ্-স্যাক্রিফায়েসের পকোড়া। জাতীয়তাবাদের তাত্ত্বিক বিশ্লেষকেরা সব রে রে ক’রে
উঠলেন। তাঁরা এর
উলটো যুক্তিতে বললেন, এটাই তো হ’ল প্রকৃত জাতীয়তাবাদ, যা একজন ব্যক্তি মানুষকে
ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ অন্তের দিকে যেতে অনুপ্রাণিত করে। তখন বেনেডিক্ট অ্যাণ্ডারসন
জাতীয়তাবাদীদের এই যুক্তির উত্তরে ভারি মজার এক কথা বলেছিলেন। It is the seductive
emotional power of the tomb of the unknown soldier. বঙ্কিম
সারাদিন ধ’রে পড়তে থাকেন রবীন্দ্রনাথের চিঠি। কী যে গভীর আনন্দ হয় ভেতরে। যেন
পুনর্জন্ম হ’ল এতদিন বাদে। গতজন্মের পাপ মলিন হয়ে এলো। তারপর কয়েকদিন ধ’রে কতজনের
মুখে মুখে যে ঘুরে বেড়ায় সে চিঠি। কতজন লিখে নিয়ে যায়। কতজন ব’সে ব’সে পড়ে। বঙ্কিম
আর গৌরকিশোর একদিন মেঘে মেঘে টাঙিয়ে দেন রবীন্দ্রনাথের চিঠি। নীল
রঙের হাওয়ায় তা পতপত ক’রে ওড়ে।
.......
Bankimchandra,
We
must remember whatever weakness we cherish in our society will become the
source of danger in politics. When our nationalists talk about ideals, they
forget that the basis of nationalism is wanting. We must never forget in the
present day that those people who have got their political freedom are not
necessarily free, they are merely powerful. In the so-called free countries the
majority of the people are not free. This becomes possible only because people
do not acknowledge moral and spiritual freedom as their object. Therefore
political freedom does not give us freedom when our mind is not free. Not only
in your relation with aliens but also with the different sections of your own
society you have not brought harmony of reconciliation. The spirit of conflict
and competition is allowed the full freedom of its reckless career. Once again
I draw your attention to the difficulties India has had to encounter and her
struggle to overcome them. Her problem is the problem of the world in
miniature. India is too vast in its area and too diverse in its races. It is
many countries packed in one geographical receptacle. It is just the opposite
of what Europe truly is, namely one country made into many. Thus Europe in its
culture and growth has had the advantage of the strength of the many, as well
as the strength of the one. India, on the contrary, being naturally many, yet
adventitiously one has all along suffered from the looseness of its diversity
and the feebleness of its unity. A true unity is like a round globe, it rolls
on, carrying its burden easily; but diversity is a many-cornered thing which
has to be dragged and pushed with all force. Be it said to the credit of India
that this diversity was not her own creation; she has had to accept it as a
fact from the beginning of her history. On the other hand, the extremists of
left wings, their ideals are based on Western history. They have no sympathy
with the special problems of India. They don’t recognize the patent fact that
there are causes in our social organization which made the Indian incapable of
coping with the alien. I am not against one nation in particular, but against
the general idea of all nations. What is the Nation? It is the aspect of a
whole people as an organized power. This organization incessantly keeps up the
insistence of the population on becoming strong and efficient. But this
strenuous effort after strength and efficiency drains man's energy from his
higher nature where he is self-sacrificing and creative. West has come to
India. Yet, someone must show the East to the West, and convince the West that
the East has her contribution to make in the history of civilization. India is
no beggar of the West. Europe has her past. We, in India, must make up our
minds that we cannot borrow other people's history, and that if we stifle our
own, we are committing suicide. When you borrow things that do not belong to
your life, they only serve to crush your life. India has never had a real sense
of nationalism. It is my conviction that my countrymen will gain truly their
India by fighting against that education which teaches them that a country is
greater than the ideals of humanity. From the earliest beginnings of history,
India has had her own problem constantly before her—it is the race problem.
Each nation must be conscious of its mission and we, in India, must realize
that we cut a poor figure when we are trying to be political. In finding the
solution of our problem we shall have helped to solve the world problem as
well. The
whole world is becoming one country through scientific facility. And the moment
is arriving when you must find a basis of unity which is not political. If
India can offer to the world her solution, it will be a contribution to
humanity. There is only one history—the history of man. All national histories
are merely chapters in the larger one. The swimmer who is an expert does not
exhibit his muscular force by violent movements, but exhibits some power which
is invisible and which shows itself in perfect grace and reposefulness. The true
distinction of man from animals is in his power and worth which are inner and
invisible. But the present-day commercial civilization of man is not only
taking too much time and space but killing time and space. Its movements are
violent; its noise is discordantly loud. It is carrying its own damnation
because it is trampling into distortion the humanity upon which it stands. It
is strenuously turning out money at the cost of happiness. Man is reducing
himself to his minimum. I do not welcome it in our Indian life even though it
be sent by the lord of the Immortals. Let our life be simple in its outer
aspect and rich in its inner gain. We must remain purely an agricultural
people. Let our civilization take its firm stand upon its basis of social
cooperation and not upon that of economic exploitation and conflict.
Rabindranath
(চলবে)
No comments:
Post a Comment