বিশ্ব
চলচ্চিত্রে ইরানীয় সিনেমার স্থান বর্তমানে যথেষ্ট ওপরে এ কথা বোধহয় অস্বীকার করার
কোন উপায় নেই। প্রায় এক ডজন পরিচালকের নাম করা যায় যাঁদের ছবি বিশ্বের কোনো না
কোনো সম্মানীয় চলচ্চিত্র উৎসব প্রতি বছর মাতিয়ে দিচ্ছে। তেমন পরীক্ষা নিরীক্ষা
সমৃদ্ধ নয়। রিয়ালেস্টিক আঙ্গিকে অনন্য সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি ও উপস্থাপনা দর্শককে
অভিভূত করে তুলছে, যা একশো ভাগ জীবন থেকে উঠে আসা শিল্প। আসলে
উন্নত ধনতান্ত্রিক সব পেয়েছি দেশের চলচ্চিত্র নির্মাতারা যা সহজে পারেন, অর্থাৎ মন যা চায় তাই প্রকাশ করতে, কোনো রাজনৈতিক বা
ধর্মীয় অনুশাসনই যাদের বাধা হয়ে দাঁড়ায় না, তাদেরই বোধহয় পরীক্ষা নিরীক্ষার তুফান
ছোটানো সম্ভব। যদিও অনেকক্ষেত্রে
যন্ত্রনা ও কষ্টহীনতা বা সব পেয়েছির বোধ স্থুল শিল্প প্রকাশের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ২য়
মহাযুদ্ধের পরবর্তী পর্যায়ে যে মানের অজস্র চলচ্চিত্র ইউরোপে নির্মিত হয়েছে, পরবর্তী অধ্যায়ে বা বর্তমানে সেই মানের চলচ্চিত্র খুব একটা হচ্ছে কি?
আমরা
জানি ইরানের মত দেশের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অনুশাসন কোন পর্যায়ের! কিভাবে প্রতি নিয়ত
কোনো না কোনো স্রষ্টাকে, বিশেষকরে চলচ্চিত্র পরিচালককে ভাবনার
প্রকাশ ঘটাতে নিত্য নতুন অভিনব পথ খুঁজতে হয়! কোনো অসতর্কে সামান্য বিতর্কিত অংশের
পরিণতি হতে পারে ভয়ংকর। জাফর পানাহির মত পরিচালককে বছরের পর বছর গৃহবন্দী থাকতে
হয়। গৃহবন্দী অবস্থাতেও প্রতিনিয়ত তিনি পথ খুঁজেছেন কি ভাবে ‘সাপও মরবে লাঠিও ভাঙবে না’ পন্থার! ঈশ্বরের করুণায়
তিনি সফল হয়েছেন। সে জন্যই হয়তো বিশ্বের দর্শকরা ‘দিস ইজ নট
এ ফিল্ম’ বা ‘ট্যাক্সি’র মতো ছবি দেখতে পেয়েছে। আশা করা যায় ভবিষ্যতেও পাবে।
এবার ইরানের কোনো ছবির আলোচনার জন্য বসিনি। বাস্তবিকই ইরানের ছবি খুব একটা
দুর্লভ নয়। সামান্য চলচ্চিত্র যাঁরা ভালোবাসেন তাঁদের ইরানীয় ছবির সন্ধান পাওয়া
খুব একটা অসুবিধাজনক নয়। আমার চলচ্চিত্র আলোচনা মূলত দু তিনটি বিষয়ের ওপর দাঁড়িয়ে
থাকে। প্রথমত এমন ধরণের ছবির আলোচনা করতে চাই চলচ্চিত্র বিশারদ ও বোদ্ধারা ছাড়া
সাধারণত সে সব চলচ্চিত্রের সন্ধান পান না বেশিরভাগ মানুষ। দ্বিতীয়ত যে সব
চলচ্চিত্রের সঙ্গে কোনো না কোন আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক বা স্মৃতি জড়িত। সিনেমার
রিভিউ বলতে যা বোঝায় তেমন আলোচনা নয়। সে কারণেই হয়তো যাঁরা প্রতিনিয়ত চলচ্চিত্র
নিয়ে নাড়াঘাঁটা করেন বা চলচ্চিত্রবিশারদ, তাঁদের এ ধরনের
আলোচনা পছন্দ হবে না। আবার এও ঠিক যাঁরা এমন ছবির সন্ধানই রাখেন না তাঁদের
তাত্ত্বিক আলোচনা পড়িয়েই বা কি হবে? আড়ালে থাকা ভালো ছবি
দেখার যদি কোনো উৎসাহ সামান্য হলেও বৃদ্ধি পায় এইসব পাঠকের, সে
কারণেই ছবির কাহিনী একটু বিষদে বলার চেষ্টা করি। বিশ্বে মহান পরিচালকদের বহু মহান
চলচ্চিত্র নানা পরীক্ষা নিরীক্ষায় নির্মিত হয়েছে, হচ্ছে।
তেমন ছবি নিয়ে চলচ্চিত্র বিশারদরা আলোচনা করছেন। আবার তাই মায়ের কাছে মাসির গপ্পো
করে বোধহয় লাভ নেই। তেমন ছবি আমার আলোচনায় সে কারণেই উঠে আসে না। নেহাৎ ‘বাক্’ আমাকে কিছুটা ব্যক্তিগত অনুভূতি প্রকাশের
সুযোগ দিয়েছে, তাই। ‘বাক্’ও জানে তেমনি আমিও জানি ‘বাক্’এর অন্যান্য বিভাগ যেমন কবিতা ও গল্প বিভাগের প্রকাশ ভঙ্গির থেকে আমার
আলোচিত বিভাগটির প্রকাশ ভঙ্গি একেবারেই ভিন্ন। ভিন্ন স্বাদও কখনও কখনও পাঠকের হয়তো
ভালো লাগতে পারে, তাই ‘বাক্’ এই বিভাগ টি এখনও হয়তো চালু রেখেছে, সে জন্য আমি
ধন্য।
এবারের আলোচনা একটি চাইনিজ ছবি নিয়ে। বর্তমানে যেমন ইরান, একবিংশ শতাব্দীর আগে পরে তেমন পৃথিবী মাতাচ্ছিল চাইনিজ ছবি। পুরোপুরি
রিয়ালেস্টিক ঢঙে বেশকিছু চাইনিজ ছবি ঐ সময় নির্মিত হয়েছিল যার একটা থেকে আর একটার
চোখ সরানো যাচ্ছিল না। এই অসাধাররণ চাইনিজ ছবিগুলি নির্মানেরও ভিত্তি বোধহয় সে সময়
চায়নার রাজনৈতিক অবস্থান। এক গভীর সন্ধীক্ষনে দাঁড়িয়ে থাকা কমিউনিজমের প্রভাব
প্রায় প্রতিটি ছবিতে। যদিও কমিউনিজমের নেগেটিভ দিকের থেকে পজিটিভ দিকই উঠে এসেছে
এই সব ছবিতে। উঠে এসেছে বোধয় সেই বিশ্বাস থেকে যে সমাজতন্ত্রের বিশ্বাস ওঁদের
শিরায় ধমনীতে প্রবহমান ছিল। কোনো শক্তি (অশুভ?) যাঁদের টলাতে
পারেনি। হয়তো এখানেই রাশিয়ার থেকে চায়নার পার্থক্য। পৃথিবীর পরিবর্তনের সাথে সাথে
কমিউনিজমকে সময় উপোযোগী করে পরিবর্তন করতে পেরেছে। বিশ্বের সব জায়গায় কমিউনিজমের
পতন হলেও চায়নাতে আজও রয়েছে। কিন্তু একি সেই আদর্শভ্যুত কমিউনিজম? বর্তমানে চায়নায়
কমিউনিজমের অবস্থান কী আমরা জানি। সেখানে কমিউনিজম এখন শুধু একটা শব্দ মাত্র। যে
বিশ্বাসের ওপর দাঁড়িয়ে একসময় কত শত মহান সৃষ্টি হয়েছে! আর আজ? যাইহোক অন্য অভিমুখে আলোচনা না
ঘুরিয়ে ছবির দিকে চোখ ফেরানো যাক।
২০০০
সালের গোড়ার সিনে সেন্ট্রাল আয়োজিত আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে বেশ কিছু নব
নির্মিত চাইনিজ ছবি এসেছিল। একটা ছবি আজও জ্বলজ্বল করে চোখের সামনে। পরিচালক জাং
ইমু।
চলচ্চিত্র
হলো বহু মাধ্যমের সংমিশ্রনে গড়ে ওঠা একটি উন্নততম মাধ্যম। একমাত্র এই মাধ্যমই
অন্যান্য প্রায় সব'কটা শিল্প মাধ্যমের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে। হয়তো
সে কারণেই কোনো একটি মাধ্যম বেগড়বাই করলে শিখর থেকে ধরনীতে পতিত হতেও পারে। এমন
পতনের বহু উদাহরণ বিশ্ব চলচ্চিত্রে খুব একটা কম নয়। একটা মহান সৃষ্টি হতে গিয়েও
হতে পারে নি। জাং ইমু হলেন সেই স্তরের পরিচালক যিনি সব শিল্প মাধ্যমকে এক সুতোয় এক
সুরে বাঁধতে পেরেছেন। যেমনটা বেঁধেছিলেন কুরোসওয়া, বার্গম্যান, তারকোভস্কি,
সত্যজিৎ রায়'রা। ইমুর প্রতিটি ছবি দেখলে বোঝা
যায় কী অসামান্য দক্ষতা ও বৈচিত্রে
একের পর এক চলচ্চিত্র নির্মাণ করে গিয়েছেন। একটির থেকে আর একটির পরিপ্রেক্ষিত, দর্শন, প্রকাশভঙ্গি একেবারেই আলাদা!
প্রথম
দৃশ্যঃ
ঝুপ
চুপ ঝুপ চুপ করে একটি কিশোরী চলেছে দুর্গম পাহাড়ি গ্রাম্য পথ দিয়ে। পথ দেখিয়ে যিনি
নিয়ে চলেছেন তার গতি কিঞ্চিত গতিশীল। পথনির্দেশকের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়েই
কিশোরীর এই ঝুপ চুপোনি গতিশীলতা। পিঠে বিছানাপত্র বাঁধা একটি বেডিং ব্যাগ। দুজনে
যেখানে এসে থামল সেটি একটি মাটির ভাঙাচোরা স্কুল। রেসিডেন্সিয়াল। পরে জানা গেল, স্কুলের একমাত্র শিক্ষক বাড়ি যাবেন একমাসের ছুটিতে অসুস্থ
মা’কে দেখতে। তার বিকল্প হিসেবে এসেছে এই ঝুপ চুপোনি মেয়েটি। বয়স
১৩। বিদ্যের দৌড় হাইস্কুলে পৌঁছয়নি। মানে প্রাইমারি বিদ্যে। এমন পুঁচকে দিদিমণিকে কেউ পাত্তা দেবে? এমনই দিদিমণি যে আবার পূর্বোক্ত শিক্ষকের সামনে তার গুনের পরিচয় দিতে
ধীরি ধীরি ঘুরি ঘুরি গানকরে নেচেও দ্যাখালো। বার তিনেক হোঁচটও খেল গান ভুলে।
ছাত্রছত্রীরা জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখল সেই আজব দৃশ্য। বিদায়ী মাস্টারমশাই গাও
দিদিমণিকে গানের লাইন ঠিক করে দিলেন।
নির্দেশ দিলেন ব্ল্যাকবোর্ডে বই দেখে লেখা কপি করে দিতে। ছেলে মেয়েরা দেখে কপি
করবে, ব্যাস।
স্কুলে
সময় দেখার ঘড়ির বালাই নেই। মাস্টারমশাই হাত দেখিয়ে একটা খুঁটি দেখালেন। খুঁটির এক
প্রান্তে সূর্যের আলো পৌঁছোলে ছুটি। যদি ওয়েদার খারাপ থাকে? আলো না পড়ে? তবে ছেড়ে দেওয়াই ভালো। কম বৃষ্টি হলে
ছাড়া যাবে না। বেশি বৃষ্টি হলে ছেলেমেয়েরা বৃষ্টির জল ধরবে। কারো লেখা আগে হয়ে
গেলে সে বাইরে খেলা করবে। ইত্যাদি ইত্যাদি নিয়মকানুনের কথা দিদিমণিকে জানিয়ে দিলেন। হিসেব করে দিনপ্রতি একটা করে চক ধার্য্য করে দিলেন মাস্টারমশাই। এক একটিতে লিখতে হবে
এক এক দিনের লেশন। খুব ছোটো অক্ষর নয়, তা হলে ছেলে
মেয়েরা দেখতে পাবে না, আবার খুব বড় লিখে লাভ নেই, চকের অপচয় হবে! এবার দিদিমণি বায়না ধরল, মেয়র তাকে বলেছিলেন ৫০ ইয়েন দেবে, তার কি হলো? টিচার গাও বললেন, ‘তবে মেয়রকেই জিজ্ঞেস করো।’ দিদিমণি নাছোড়বান্দা, আর টিচার গাও
দিতে রাজি নন। গাও জানালেন তিনি নিজেই ৬ মাস বেতন পাননি, তো
কী করে টাকা দেবেন?
দিদিমণির মন ভালো নেই। পরদিন ভোরে টিচার গাও যখন মেয়রের ট্রাকে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন, দিদিমণি ছুটল
গাড়ির পেছনে। গাড়ি দাঁড়াতে সেই এক কথা, ‘আমার ৫০ ইয়েন
কি হল?’ মেয়র বললেন, ‘তুমি ঠিক ঠাক
পড়াও, তোমার টাকা ঠিক সময়ে পেয়ে যাবে।’ টিচার গাও গাড়ি থেকে নেমে দিদিমণিকে বললেন। ‘তুমি সমস্ত ছাত্রছত্রীদের ভালো করে নজর
রাখবে, এক জনকেও যেন হারাতে না হয় (Not one less)। ইতিমধ্যে ১০ জন পালিয়েছে, আর
একজনও যেন না পালায়! যদি ঠিক ঠাক ওদের রাখতে পারো, তবে
তোমাকে এর জন্য আমার তরফ থেকে ১০ ইয়েন দেবো।’
খুদে দিদিমণির মাথায় 'Not
one less' কথাটা খেলে গেল। তার পর থেকে দিদিমণির যেন একটাই কাজ যেন তেন প্রকারেন ছাত্রছাত্রীদের আটকে রাখা। টিচার গাও-এর কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে চলা। সে
শুধু চক দিয়ে বই থেকে কপি করে দ্যায় ব্ল্যাকবোর্ডে। ছাত্রছাত্রীরা লিখল কি
মারামারি করে মরল দিদিমণির কিছু
যায় আসে না। দরজার বাইরে পা ছড়িয়ে ঠায় বসে থেকে পাহারা দ্যায়। কেউ হিসি করতে গেলেও
সে সঙ্গে যায়।
তাকে
টিচার হিসেবে কেউ পাত্তা দেয় না। একদিন প্রার্থনার সময় মেয়র ছাত্রছাত্রীদের
বললেন, ‘টিচার গাও-এর মা খুবই অসুস্থ। উনি একমাস
থাকবেন না। এখন টিচার উই তোমাদের দেখাশোনা করবে। সবাই একে টিচার উই বলে ডাকবে’।
একজন
বলল, ‘এ আমাদের টিচার হতেই পারে না’।
একটি
দুষ্টু ছেলে বলল, ‘এ তো আমাদের পাড়ার উই চানঝিসের বোন।’
মেয়র-
তাতে কি হলো? আমি বলছি এ তোমাদের টিচার।
- না।
- আমি বলছি বল, টিচার
উই।
জোর
করে বলালেন বটে মন থেকে কেউ মেনে নিলনা।
দিদিমণি একটু কষ্ট পেলেও, তার আসল লক্ষ্য
একটাই, টিচার গাও-এর নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করা (Not
one less)।
একদিন
মেয়র আর শহর থেকে আগত ফিজিক্যাল ট্রেনার দ্রুত দৌড়োতে পারে এমন একজন ছাত্রীকে
ইন্টার স্পোর্টস কম্পিটিশনে নিয়ে যাওয়ার জন্য নির্বাচন করলেন, কিন্তু বেঁকে বসল দিদিমনি। কিছুতেই ছাত্রীটিকে সে ছাড়বে না। যতই বোঝানো হয়
এটা স্কুলের সম্মানের ব্যাপার। টিচার গাও কিছু মনে করবেন না। কে শোনে কার কথা!
দিদিমণি নাছোড়বান্দা। মেয়র ও ট্রেনার
পরেরদিন সকালে যখন ছাত্রীটিকে গাড়িকরে নিতে এলেন, তার
আগেই দিদিমণি কোথাও
ছাত্রীটিকে লুকিয়ে রেখেছে। কিছুতেই দিদিমণি স্বীকার করলো না কোথায় ছাত্রীটি! শেষে এক বিচ্ছু ছাত্রকে কিছু ঘুষ দিয়ে জানা
গেল কোথায় ছাত্রীটিকে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। গাড়ি করে তারা যখন শহরের উদ্দেশ্যে চুপিসারে রওনা দিল, দিদিমণি জানতে
পেরে ছুটল গাড়ির পেছন পেছন বহুদূর। আছাড় খেয়ে পড়ল রাস্তায়। গাড়ি থামল না।
রোল কল করতে গিয়ে একদিন জানা গেল ঝাং হুইকে বলে একজন ছাত্র অনুপস্থিত। কেন? এই হুইকেই সেই ছেলে যে মেয়রের নির্দেশ সত্ত্বেও কিছুতেই দিদিমণিকে মেনে নিচ্ছিল না। এই হুইকেই সেই দুষ্ট ছেলে যে ঘুষ খেয়ে তার লুকিয়ে রাখা ছাত্রীর কথা বলে দিয়েছিল। স্বভাবতই রাগ গিয়ে পড়েছিল ছেলেটির ওপর। সারারাত দাঁড়
করিয়ে রেখেছিল ছেলেটিকে। কারণ ওর জন্যই একমাসের চকের স্টক মাটিতে পড়ে ভেঙে গুঁড়িয়ে
যায়। শেষে ছেলেটি ঘুষের কামানো টাকা চক কিনতে দিয়ে ছাড়া পায়। দিদিমণি কষ্ট পেল। তবে কি সে জন্যই সে পালিয়েছে? হুইকের বাড়ি খুঁজে জানতে পারল সে কাজের সন্ধানে শহরে গিয়েছে। তার বাবা নেই,
মা অসুস্থ। মেয়রের সঙ্গে দেখা করে সে জানাল
ব্যাপারটা। কিছু প্রাপ্য টাকা পেলে সে শহরে
গিয়ে হুইকের খোঁজ করতে পারে। মেয়র কোনো টাকা দিতে রাজি হলো না।
দিদিমণি যাবেই। কিন্তু টাকা কোথায়? ছাত্রছাত্রীদের
কাছে হাত পেতে এক দু টাকা করে সামান্য কিছু জোগাড় হলো। একজন ছাত্রী বলল পাহাড়ের
কোলে ইটভাঁটা, পোড়ানোর কাঁচা ইট বইলে কিছু টাকা পাওয়া যেতে পারে। ছাত্রছাত্রীরা
রাজি শুনে দিদিমণি সবাইকে নিয়ে গেল ইটভাঁটায়। মালিক ছিলেন না। নিজেদের ইচ্ছেতেই
সবাই মিলে প্রায় এক হাজার কাঁচা ইট বয়ে দিল। মালিক ফিরে টাকা দেওয়া তো দূরের কথা
কেন তারা নিজের ইচ্ছায় ইট বয়েছে সে নিয়ে শুরু করলেন হম্বিতম্বি। কারণ বাচ্চারা
বইতে গিয়ে অনেক কাঁচা ইট ভেঙে ফেলেছিল। শেষে সব ছাত্রছাত্রী মালিককে ঘিরে ধরে
কিছু টাকা একপ্রকার বাগিয়ে ছাড়ল।
মজার
ব্যাপার এই ইট বওয়া নিয়েই খুদে দিদিমণি কিন্তু চমৎকার ছাত্রছাত্রীদের অঙ্কও শেখাল। একজন একটা ইট বইতে এই সময় নিলে
হাজার ইট বইতে কত সময় নেবে? ইত্যাদি ইত্যাদি।
ছাত্রছাত্রীরাও বেশ মজায় অঙ্ক শিখল, আড়াল থেকে মেয়রও দিদিমণির বাড়তি অঙ্ক শেখানো পেয়ে খুশি হয়ে বাড়ি গেলেন।
দিদিমনি হুইকের খোঁজে পাড়ি দিল শহরে। টিকিট না কেটে বাসে চেপেও বিশেষ সুবিধে
করতে পারল না। কিছুদূর যেতেই গাড়ি থেকে নামিয়ে দেওয়া হলো। ক্ষোভের প্রকাশ জানাল
বাসের গায়ে তার নরম হাতের চাপড় মেরে। হাঁটা ছাড়া উপায় ছিল না। পাহাড়ি উঁচু নিচু পথ
বেয়ে হাঁটতে হাঁটতে গলদঘর্ম হয়ে প্রায় ৫০ কিমি রাস্তা পেরিয়ে শহরে এসে পৌঁছলো।
হুইকের মায়ের দেওয়া ঠিকানায় গিয়ে জানতে পারল স্টেশনে বাথরুমে গিয়ে হুইকে
হারিয়েগিয়ে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
হুইকের
খোঁজে ঘুরতে ঘুরতে একটা দেওয়ালে হাতে লেখা নিরুদ্দেশের উদ্দেশ্যে পোস্টার চোখে
পড়লো দিদিমণির। মাথায় খেলল একটা ব্যাপার। সেও অমন পোস্টার লিখে চারদিক ছড়িয়ে দেবে। দোকান থেকে ১০০ কাগজের বান্ডিল, কালি ও কলম কিনে সারারাত ট্রেনের ওয়েটিং রুমে বসে পোস্টার লিখল। ভোরের
দিকে একজন বাথরুম যাওয়ার সময় তার লেখা পোস্টার পড়ে জানাল, পোস্টারে যোগাযোগের
ঠিকানা নেই, নম্বর নেই, কোনো কাজে লাগবে না।
সময়ের অপচয় ছাড়া কিছু নয়। দিদিমণি হতাশ।
বাথরুম পর্যন্ত ছুটল লোকটির কাছে। তবে কী করবে সে? লোকটি
জানাল থানায় যাওয়া যেতে পারে। টিভির মাধ্যমে ঘোষনা হলে সবচেয়ে ভালো হয়। শেষ
পরামর্শটি দিদিমণির মনে
ধরল। ভোরের আলো ফুটতেই সে চলল
টিভি সেন্টারের উদ্দেশ্যে। স্বভাবতই তাকে গেটে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। সিকিউরিটি অফিসের
এক মহিলা হাজারো নিয়ম কানুনের কথা বলে তাকে গেটের বাইরে বের করে দিলেন। শুধু এটুকু জানিয়েছিলেন, যদি কেউ কিছু করতে পারেন তবে তিনি স্টেশন ম্যানেজার স্বয়ং।
শুরু হলো দিদিমণির স্টেশন
ম্যানেজার খোঁজা। গেট দিয়ে যে বেরোয় তাঁর কাছেই সে জানতে চায়, ‘আপনি কি স্টেশন ম্যানেজার?’ সাইকেল চড়া কোনো
কর্মচারিই হোক কিংবা মুটে মজুর হোক। কাউকে সে বাদ দিল না। একবার একটু অন্যমনস্কতায়
একজন সাইকেই চালিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন, দিদিমণি ছুটতে ছুটতে গিয়ে তাঁকে ধরল, 'আপনি
কি স্টেশন ম্যানেজার'?
সন্ধে হলো, রাত হলো, টিভি সেন্টারের গেটে তালা পড়ল।
দিদিমণি অনুভব করল এবার তার খিদে
পেয়েছে। অবশিষ্ট কোনো টাকা নেই। যা ছিল কালি কাগজ কিনে ফেলেছে। রাস্তার ধারের একটা
রেস্টুরেন্টে খাবারের টেবিলের প্লেটে পড়েছিল আধখাওয়া কিছু খাবার। নিমেষে তাই
চেটেপুটে খেল দিদিমণি।
অন্যদিকে হুইকে-কে দেখা গেল পথে পথে ঘুরতে। যাদের হেফাজতে কাজের সন্ধানে
এসেছিল তাদের সঙ্গে ছাড়াছাড়ির পর ওর আর কিছু করার ছিল না। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে
থাকে রাস্তার ধারের সাজানো খাবারের দিকে। কখনও কেউ ডেকে কিছু একটা খেতে দেয়। ওপেন
এয়ার রেস্টুরেন্টে খাবারের টেবিলে আশে পাশে ঘুর ঘুর করে ড্যাব ড্যাব করে চেয়ে
থাকে। একদিন রেস্টুরেন্টের মালকিন তাকে ভেতরে ডেকে নিয়ে কিছু খাবার খাওয়ালেন।
বললেন ওভাবে তার খদ্দেরদের খাওয়ারের দিকে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে তার ব্যবসার ক্ষতি
যেন সে না করে। বরং খিদে পেলে এখানে খেয়ে যাক। কিছু ধোয়াধুয়ির কাজ করে দিলেই হবে।
তাই করতো হুইকে।
এদিকে সে রাত্রে দিদিমণি একসময়
ঘুমিয়ে পড়ল টিভি সেন্টারের পাশে খুঁটিতে হেলান দিয়ে। পাশে রাখা তার হাতে লেখা
পোস্টার। হাওয়ায় উড়তে উড়তে রাস্তায় ছড়িয়ে পড়ল সব। ভোর বেলা ঝাড়ুদাররা ঝেঁটিয়ে সব
পোস্টার সাফ করে দিলেও গভীর ঘুমে দিদিমণি কিছুই টের পেল না।
একজনের ডাকে দিদিমণির ঘুম
ভাঙল। সে আগের দিন অফিস থেকে বেরোনোর সময় দেখেছিল মেয়েটিকে। কীভাবে বাচ্চা মেয়েটি
জনে জনে জানতে চাইছে স্টেশন ম্যানেজারের কথা! ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা করে তিনি
জানালেন ব্যাপারটা। ম্যানেজার সিকিউরিটি গার্ডের মহিলাকে তিরস্কার করলেন তার অমানবিক আচরণের
জন্য।
দিদিমণিকে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হলো।
খাওয়ানো হলো। লাইভ অনুষ্ঠানে দেখানো হলো তার ইন্টারভিউ। বার বার তাকে কিছু বলতে
বললেও ক্যামেরা আর আলোর ঝলকানির সামনে কোনো কথা সরছিল না কচি দিদিমণির মুখ দিয়ে। অনেক পরে একসময় ডুকরে কেঁদে উঠল। স্বতঃস্ফুর্ত
ভাবে বেরিয়ে এল কটি কথা ‘হুইকে কোথায় তুই? আমি
যে কত তোকে খুঁজেছি। কত কষ্ট করে তোকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এসেছি!’
ছড়িয়ে
পড়ল শহরময় টিভি সম্প্রচার। রিপিট টেলিকাস্টের সময় হুইকের মালকিন হুইকে-কে ডেকে
নিয়ে গেল টিভির সামনে। হুইকে দেখলে টিভিতে দিদিমণি। চোখে জল। তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এসেছে। দুষ্টু হুইকের চোখেও নেমে এল
অশ্রুধারা।
টিভি রিপোর্টার, ক্যামেরাম্যান সহ গাড়ি করে সগৌরবে তারা
ফিরে এল গ্রামে।
বিভিন্ন
উপহারের মধ্যে স্কুলের ছাত্র ছাত্রীদের জন্য আনা হয়েছিল প্রচুর রঙীন চক। সেই চক
দিয়ে শেষ দৃশ্যে এক অভিনব খেলা খেলতে দেখা গ্যালো দিদিমণি সহ প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীকে। এক একজন রঙিন চক দিয়ে মাত্র একটি শব্দ লিখবে। কেউ
লিখল গাছ, কেউ পাখি, কেউ জল,
কেউ নদী। হুইকে লিখতে উঠে দিদিমণির অনুমতি চাইল, একের অধিক শব্দ লিখতে পারে কী? অনুমতি পেল। ব্ল্যাকবোর্ডে গিয়ে হুইকে লিখল, ‘টিচার
উই’।
দিদিমণির চোখে আনন্দ অশ্রু, এই প্রথম হুইকে
তাকে টিচার বলে মেনে নিল।
।। সমাপ্ত ।।
আপাতভাবে মনে হতেই পারে দুইয়ে দুইয়ে চারের ছক। কিন্তু কখনো এমন ছক
অনেক ছকহীনতারও বেশিকিছু অবদান রেখে যায়। যা চিরস্মরনীয় হয়ে থাকে। হাজারো ছরির
ভিড়ে আজও তাই জ্বল জ্বল করছে ঐ ছবিটি আমার স্মৃতিতে। এ্যাতো নিখুত উপস্থাপনা আর অনবদ্য বাচ্ছা ছেলেমেয়েদের অভিনয়, এককথায় অবিশ্বাস্য! সমাজতন্ত্রের বিশ্বাস সিরায় উপসিরায় প্রবহমান না হলে
এমন নিখুত ভাবনা, উপস্থাপনা ও অভিনয় সমৃদ্ধ ছবি শুধু
নির্মানের দক্ষতায় করা সম্ভব হতো? মনে হয় না।
অবশ্যই
দেখুন, Not one less.
(চিত্রঋণ : আন্তর্জাল)
No comments:
Post a Comment