।। কবির ভূমিকায় অভিনয়
করতে করতে ১দিন আমরা সবাই সত্যিকারের
কবি হয়ে যাব না তো? হয়ে গেলেই মন্দ কী? আমরা সকলেই জানি কবির মধ্যে কোনো বিপদ নেই।
বিপজ্জনক হতে পারে লেখা। কোন লেখা বিপজ্জনক? যে লেখা নিয়ে চিন্তা করতে হয়। চিন্তা
হল বারুদের চেয়ে বিপজ্জনক, এ কে ৪৭-এর চেয়ে মারাত্মক। এটা মনে রাখা ভালো। কারণ, মন
আপনার দেবতা।
পাঠকের নাম হয়ত জানা যাবে না। কোনোদিন হয়ত তার সঙ্গে কথা হবে না। আমরা অনেক সময়ই এমন ব্যক্তিকে নিজেদের পাঠক ভাবি, যে আসলে লেখক, কিন্তু ঠিকঠাক লিখতে শেখেনি, লিখতে পারে
না। সে এসেছে আত্মবিশ্বাসের খোঁজে। আর আমরা পাচ্ছি আত্মপ্রসাদ। অথবা, লেখার জগতের
সহকর্মীদের ভাবছি নিজেদের পাঠক। এটা আরো মারাত্মক। একজন রাঁধুনী তার রান্না আরেক
রাঁধুনীর জন্য, একজন ডাক্তার তার দক্ষতা আরেক ডাক্তারের জন্য, একজন মুচি তার
হস্তকৌশল আরেক মুচির জন্য রাখে না। কিন্তু একজন কবি আরেকজন কবির প্রশংসা পেলে গলে
যায়, নিন্দা পেলে মুষড়ে পড়ে, সে অ-কবিদের পাত্তাই দিতে চায় না। পাঠক কাকে বলে, সে
তখন আর ভেবে দ্যাখে না। এটাও ভেবে দ্যাখে না, সহকর্মীর ঈর্ষা থাকতে পারে, অকারণ
স্নেহও থাকতে পারে। তার মতামতটা প্রভাবিত হতেই পারে।
ভবভূতি
এক জায়গায় লিখেছেন- কবিকে অকবি বলে আর
সতীকে অসতী বলে দুর্জনরা সুখ পায়। আর সুজনদের কী হবে? যাঁরা তেঁতুলপাতা শেয়ার করেই
আনন্দ পান? আমাদের অনেকের ছেলেবেলায় টিভিতে সিনেমা হত। সাদাকালো টিভি। কালোসাদা
সিনেমা। শনিবার হিন্দি। রবিবার বাংলা। সারা সপ্তাহের হাপিত্যেশ। বিশেষ করে রবিবার
বিকেলের জন্য মা-বোন-দিদি-বৌদি-কাকিমা-জেঠিমাদের একটা আলাদা অপেক্ষা থাকত। তাঁরা
শনিবারের শশী কপূর শাম্মি কপূরদের খুব একটা দেখতেন না, রান্নার ফাঁকে এসে বসতেন,
উঁকি-টুকি দিতেন গানের আওয়াজ পেলে। রবিবারটা আলাদা ব্যাপার। খবরের কাগজে দেখা যেত
আছে সুচিত্রা সেন-উত্তমকুমার অভিনীত ‘শাপমোচন’, অথবা ‘সবার উপরে’। কিংবা তাপস
পাল-দেবশ্রী রায়ের কোনো ‘গানভিত্তিক’ সিনেমা। রবিবারের সকাল থেকে মহিলাদের মুখে
আলাদা উজ্জ্বলতা। পুরুষদের মুখ প্রসন্ন। পাড়ায় যাদের টিভি নেই, বাচ্চাদের পড়া নষ্ট
হয়ে যাওয়ার ভয়ে, বা টিভি কেনাটা বিলাসিতা বলেই, ভিড় করে আসতেন। পানের গন্ধ, জর্দামিশ্রিত, অথবা দোক্তা, চায়ের গেলাসের আওয়াজ,
বিভিন্ন আঁচলের খসখস। একটা হাল্কা উৎসব। কিন্তু যেদিন থাকতেন সত্যজিৎ রায় তাঁর
কোনো সিনেমা নিয়ে, মহিলাদের উজ্জ্বলতা
আর পুরুষদের প্রসন্নতা প্রায় গায়েব। সেদিন ভিড় কম। জর্দার গন্ধ কম। চায়ের গেলাসের
আওয়াজটা মনমরা। শেষ অবধি সিনেমাটা বাড়ির বাচ্চারাই দেখত। বড়রা গল্পগুজব করে কাটিয়ে
দিতেন। আর যদি থাকতেন মৃণাল সেন তাঁর ‘ইন্টারভিউ’ বা ‘আকালের সন্ধানে’ নিয়ে, সেদিন
ভিড় আর বলা যায় না। যে দু-চারজন এসেছিলেন, খবরের কাগজ দেখেননি বলেই, আধঘন্টার
মধ্যে চলে গেলেন। বাড়ির কর্তা নিজেই সেই যে পান খেতে গেলেন পাড়ার মোড়ে, সাতটার আগে
বাড়ি ফিরলেন না। কার সঙ্গে যেন দেখা হয়ে গিয়েছিল।
সুচিত্রা সেন আর মৃণাল সেনের মাঝখানে এই যে এক দুস্তর খাদ, সেখানে বনলতা
সেনহীনভাবে কবিতা নিয়ে বেঁচে থাকা খুব কষ্টকর। ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’ ‘তুমি যে
আমার’ বা ‘শোনো বন্ধু শোনো প্রাণহীন এই শহরের ইতিকথা’-র রকমফের করেই চলছে বাংলা
কবিতার বাজার। ধুঁকে ধুঁকে। নাহলে কর্তা পান খেতে বেরিয়ে যাবেন, কবির লেখা বন্ধ না
হওয়া অবধি কার সঙ্গে যেন তাঁর দেখা হয়ে যাবে।
তথাকথিত পাঠকের প্রশংসা তো সন্দেহজনক। আপনার কবিতা বা লেখার স্তুতি করেই
তিনি এমন লেখা বা সো কলড কবিতার অকুন্ঠ সুখ্যাতি করতে পারেন যেখানে আপনার মতে লেখা
বা কবিতা ব্যাপারটাই নেই। তাহলে আপনার লেখায় তাঁর প্রশংসার আর কি কোনো মূল্য রইল
আপনার কাছে? আর যাঁরা সত্যিই বোদ্ধা, সত্যিকারের রসিক, তাঁরা আপনার সম্পর্কে কোনো
শব্দ খরচ করার আগে দশ হাজারবার ভাববেন। আপনাকে মাপবেন। আপনি যদি দুর্ধর্ষ কিছু কাজ
করেও থাকেন, তাতে তাঁদের কী? বরং তাঁদের অসুবিধাই হতে পারে। আপনার যে ব্যাপারটা
শক্তি, সেটা তাঁদের হিরোসিমায় পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটাবে না, এটা কি কেউ বলতে
পারেন?
এভাবেই আমরা চলছি। এবং, বাংলা কবিতা আজ পৃথিবীর মধ্যে পিছিয়ে নেই। আমরা
কবিতা নিয়েই বেঁচে আছি। কবিতা আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে। রাখবে। কবিতাহীনভাবে বেঁচে
থাকার কোনো মানেই হয় না। এবং, যেহেতু, কবিতা লেখার কোনো মানে হয় না, লেখা কবিতারও
কোনো মানে হয় না।।